বিডিআর হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগের দলগত সম্পৃক্ততা, সমন্বয়ক ছিলেন তাপস: তদন্ত কমিশন

 



বিডিআর হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগের দলগত সম্পৃক্ততা, সমন্বয়ক ছিলেন তাপস: তদন্ত কমিশন

পিলখানায় সংঘটিত নৃশংস বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে কমিশন জানায়, ঘটনাটিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দলগত সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে এবং পুরো ঘটনার মূল সমন্বয়ক ছিলেন সে সময়ের সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেন কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান ও অন্যান্য সদস্যরা। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তথ্যটি জানায়।

ফজলুর রহমান বলেন, “তদন্তকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও নির্ভুলতার সঙ্গে সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে।” তিনি জানান, ১৬ বছর আগের ঘটনার অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে দেশ ছাড়ায় তদন্ত জটিল হয়ে পড়ে। তবুও শতাধিক সাক্ষীকে ডাকা হয়, কারও বক্তব্য ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত শোনা হয়েছে, আগের তদন্তের রিপোর্ট ও বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে বিস্তৃত বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনমনে থাকা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে—কে কী ভূমিকা রেখেছিল এবং কেন সেনাবাহিনী সেসময় হস্তক্ষেপ করেনি, এ বিষয়গুলোও যাচাই করা হয়েছে।

কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার জানান, তদন্তে ঘটনা সংঘটনের বাহ্যিক কারণের পাশাপাশি প্রকৃত উদ্দেশ্যও বেরিয়ে এসেছে। তাঁর মতে, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং এর পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি আরও দাবি করেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ জড়িতদের রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা নেয় এবং ঘটনাস্থলে একটি মিছিল নিয়ে প্রবেশ করে; বের হওয়ার সময় সে মিছিলে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দুই শতাধিক হয়ে যায়।

জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, পুরো ঘটনার পেছনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, এ ঘটনার দায় তৎকালীন সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সেনাপ্রধান পর্যন্ত বিস্তৃত। পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও ‘চরম ব্যর্থতা’ ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং কয়েকজন সাংবাদিকের আচরণকেও তিনি ‘অপেশাদার’ বলেন।

তিনি আরও জানান, যেসব বিডিআর সদস্য রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁদের সঠিক পরিচয় ও তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি, যা তদন্তে জটিলতা সৃষ্টি করেছে।

কমিশন তাদের প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে বাহিনীসমূহে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে।

প্রতিবেদন গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতি দীর্ঘদিন অন্ধকারে ছিল। আপনারা সত্য উদ্ঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছেন, জাতি তা স্মরণে রাখবে।” তিনি আরও বলেন, এই প্রতিবেদন ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনার বহু প্রশ্নের সমাধান আনবে এবং জাতির জন্য একটি মূল্যবান দলিল হয়ে থাকবে।

মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশনে ছিলেন—মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. সাইদুর রহমান বীর প্রতীক, মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ, এম আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।

প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হাফিজ এবং স্বরাষ্ট্রসচিব নাসিমুল গনি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ