সময়ের স্রোতে বেগম জিয়া: এক স্মৃতিময় সম্ভাব্য শেষ নির্বাচন
রাজনীতিতে শুধু প্রার্থিতা নয়, উপস্থিতিই সবচেয়ে বড় শক্তি। এবার বেগম জিয়া উপস্থিত থাকবেন নাম দিয়ে, প্রতীক দিয়ে, স্মৃতির মধ্য দিয়ে—কিন্তু সশরীরে নয়। এটি শুধু রাজনীতির নয়, সময়ের নির্মমতা ও মানবজীবনের অনিবার্য পরিবর্তনেরও প্রতিচ্ছবি।
মনে পড়ে ২০০৮ সালের নির্বাচন। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সীমিত সময়ের মধ্যেও কী দারুণ প্রচারণা চালিয়েছিলেন তিনি! শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই তার পদচারণা ছিল দৃপ্ত। বিএনপি তখন ভয়াবহ সংকটে, কিন্তু বেগম জিয়া ছিলেন অবিচল। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা তখন রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভায় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন—“পদ্মা সেতু চাই? মেট্রোরেল চাই? বলো…” সেই দৃশ্য অনেকের মনে প্রশ্ন জাগিয়েছিল—এটা কি প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নাকি সবকিছু আগে থেকেই নির্ধারিত?
ইতিহাসের বিচারে ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল ক্ষমতার সমঝোতা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রকৌশলের এক অধ্যায়। মঈন ইউ আহমেদ এবং সেনা-সমর্থিত শক্তির হিসাব-নিকাশে দেশ যেদিকে গিয়েছিল, সেখানে বেগম জিয়া ছিলেন একা। তার প্রতিবাদ ছিল সাহসী, দৃঢ়—কিন্তু বাস্তবতা ছিল নির্মম।
এরপর কেটে গেছে প্রায় সতেরো বছর। রাজনীতির চেহারা পাল্টেছে, চরিত্র বদলেছে, নেতৃত্বের ধরন ও ভাষাও বদলেছে। কিন্তু বেগম জিয়া? তিনিও বদলেছেন, তবে রাজনৈতিক কারণের চেয়ে সময়ের ছোঁয়াতেই বেশি। বয়স, অসুস্থতা আর চিকিৎসা—এই তিনটি শব্দ আজ তার রাজনৈতিক জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করছে। এ পরিবর্তন শুধু রাজনৈতিক নয়; তা গভীরভাবে মানবিক এবং বেদনাময়।
এই নির্বাচনকে অনেকে বলছেন “স্মৃতির নির্বাচন”—শুধু বেগম জিয়ার জন্য নয়, বিএনপির অনেক প্রবীণ নেতার জন্যও। হয়তো মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জন্যও এটি হতে পারে রাজনীতির শেষ অধ্যায়। কয়েকজন অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান নেতাও হয়তো এবার পর্দার আড়ালে সরে যাবেন। তাই এই নির্বাচন শুধু ক্ষমতার নয়, নেতৃত্বের প্রজন্মান্তরেরও প্রতীক।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—যদি তিনি জেতেন, আগের মতো কি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতে পারবেন? সেই কণ্ঠ কি আবারও মানুষকে জাগাতে পারবে? হয়তো পারবেন, হয়তো পারবেন না। কিন্তু জাতি এখনো অপেক্ষায়—তার দেশপ্রেমের কণ্ঠ শোনার জন্য।
বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনীতিক নন; তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক ভারী প্রতীক। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি তিনি এক মায়ের প্রতিচ্ছবি, এক প্রতিবাদের প্রতীক, ক্ষমতা হারিয়েও স্থির ধৈর্যের প্রতিমা। সময় মানুষকে বদলায়, কিন্তু ইতিহাস কখনও বদলায় না—সে শুধু নীরবে সাক্ষী হয়ে থাকে।
আজ তাকে দেখি ধীর পদক্ষেপে, শারীরিক সীমাবদ্ধতা বুকে নিয়ে, তবুও রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টায়। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের সেই অনাস্থা প্রস্তাব—কী অদম্য শক্তিতে তিনি তা প্রতিহত করেছিলেন! তখনকার বেগম জিয়া ছিলেন ঝড়ের মতো, সূর্যের মতো, ঢেউয়ের মতো। আজ তিনি সেই সূর্যের ম্লান আলো, সেই ঢেউয়ের নিস্তব্ধতা।
কিন্তু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্মৃতি—এসবের কি বয়স হয়?
জাতি চায় আবার তার কণ্ঠ শুনতে। হয়তো শেষবারের মতো, হয়তো নতুন এক সূচনার প্রত্যাশায়। কিন্তু সময় তার নিজস্ব গতিতে চলে—নির্লিপ্ত, অনমনীয়। সময়ই বদলে দিয়েছে বেগম জিয়ার জীবন, সময়ই বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি।
তাই এই নির্বাচন কেবল ভোট নয়; এটি স্মৃতি, অস্তিত্ব, আবেগ ও ইতিহাসের এক নতুন বিচার। বাকিটা সময়ের হাতে তুলে দেওয়া যায়।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের এক সংবেদনশীল মুহূর্তে—যেখানে স্মৃতি, রাজনীতি, আবেগ ও সময় পরস্পরকে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই নির্বাচন তাই শুধুই নির্বাচন নয়—এ যেন বিদায়ের সম্ভাব্য সংগীত।
শেষে শুধু প্রার্থনা: মাতৃসম বেগম খালেদা জিয়া যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, আবার দাঁড়াতে পারেন, এবং আমরা যেন আবার শুনতে পারি তার সেই দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
আল্লাহ তাকে সুস্থতা দান করুন, এবং এই স্মৃতি যেন বিদায়ের নয়, বরং আরেকটি নতুন শুরু হওয়ার স্মৃতি হয়ে থাকে।

0 মন্তব্যসমূহ