হাসিনার বিচার ও আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি



হাসিনার বিচার ও আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

একটি দৃশ্য কল্পনা করা যায়: বহু বছর ধরে বিপুল ক্ষমতা নিয়ে দেশ শাসন করা এক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জনঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠল এবং আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিল। মৃত্যুকাঠের পথে তিনি ভাবেন—তার অপরাধ আসলে কী? এই আত্মসমালোচনার সুর মিলে যায় ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের দ্য প্যাট্রিয়ট কবিতায়, যেখানে বলা হয়েছে—একদিন যার সম্মান আকাশছোঁয়া, পরদিন সেই নায়কই অধঃপতনের মুখোমুখি হতে পারেন।

কবিতাটির একটি সরল বাংলা অনুবাদ এমন—


“বৃষ্টিভেজা আমি দৌড়াই মৃত্যুকাঠের দিকে, পিছনে বাঁধা দু’হাত ক্ষতবিক্ষত, কপাল থেকেও রক্ত ঝরছে বোধহয়। যে-ই পারে, আমাকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে—এক বছরের কাজের এই আমার ফল। এভাবেই আমার আগমন ও বিদায়! এক বছরের শ্রমের এমনই পরিণতি।”

এই গল্পটি ৭৬ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেত্রীকে ঘিরে। প্রায় ৪৭ বছর ধরে শেখ হাসিনা দলটির সভাপতি এবং প্রায় ২৭ বছর তিনি জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু—কখনো প্রধানমন্ত্রী, কখনো বিরোধী নেত্রী হিসেবে। নির্বাহী ক্ষমতা হারালেও তিনি রাজনীতির প্রধান আলোচ্য চরিত্র। দলের ভেতরে তাঁর অবস্থান প্রশ্নাতীত—প্রায় দেবতুল্য। দেশে না থেকেও, ১৫ মাস পরেও, আওয়ামী লীগ মানেই যেন শেখ হাসিনা। ফলে প্রশ্ন জাগে—এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী?

দেশ–বিদেশের ইতিহাস বলে, ব্যর্থতার পরও নেতা বা দল অনেক সময় আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আওয়ামী লীগও কি আবার রাজনীতির ময়দানে আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে পারবে? সংশয় দেখা দেয় কারণ—অত্যন্ত ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দল থেকে নেতা সরলে দলটি টিকে থাকতে পারে কি না, তা অনিশ্চিত।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়—নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু “নেতা মুজিব” আর “শাসক মুজিব”—এই দু’টি ভূমিকাকে একই মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও তিনি সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থায় সফল হননি। মাত্র তিন বছরের মাথায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে তিনি নিহত হন সামরিক অভ্যুত্থানে—আর তাঁর দল কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেনি।

তবুও আওয়ামী লীগ পরে পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়—আংশিক কারণ, তখনকার শাসকগোষ্ঠী দলটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু ২০২৫ সালে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে, এবং বর্তমান শাসকেরা অতীতের তুলনায় অনেক কম সহনশীল। নিষেধাজ্ঞা না উঠলে দলের ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখন প্রশ্ন—দলটি কি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ তৈরি করে আবারও উন্মুক্ত রাজনীতির সুযোগ আদায় করতে পারবে?

উল্লেখযোগ্য যে, প্রথম দিকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠেনি। দাবি ছিল ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার’। হঠাৎ পরিস্থিতি মোড় নেয়। নবগঠিত এনসিপি কর্মী–সমর্থকেরা রাস্তা অবরোধ করে জামুনায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে অগ্রসর হলে সরকার নির্বাহী আদেশে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে।

সরকারি প্রভাবাধীন নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে দলের নিবন্ধন স্থগিত করে এবং ‘নৌকা’ প্রতীক তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর বহু দল একই সুরে কথা বলতে শুরু করে। কেউই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় প্রকাশ্যে এগিয়ে আসতে চায় না। কেবল কিছু মানুষ নরম কণ্ঠে ১৯৭২ সালের সংবিধানের কথা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বা দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি রাখার কথা বলেন—সেটিও খুব সতর্ক সুরে।

কিন্তু রাজনৈতিক দল যদি মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়, তাকে মুছে ফেলা কঠিন। জামায়াতে ইসলামী তার বড় উদাহরণ—পাকিস্তান ও বাংলাদেশে চারবার নিষিদ্ধ, নেতা মওদুদী পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত—তবুও দলটি বিলুপ্ত হয়নি।

যখন প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায় বা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন দলগুলো গোপনে চলে যায়—হঠাৎ হামলা, বোমা, অগ্নিসংযোগে জড়িয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ও জাসদের বিপ্লবী গণবাহিনীর কর্মকাণ্ড দেশ এখনো ভুলে যায়নি। আজ আওয়ামী লীগের কর্মীরাও নানা স্থানে সেই পথ অনুসরণ করছে—হঠাৎ অবরোধ ডেকে জনজীবন অচল করে দিচ্ছে।



আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হলো—তারা নিজেদের ভুল কখনো স্বীকার করে না; অনুশোচনাও দেখায় না। এ কারণে সমাজের বড় অংশে তাদের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে। তবে এটিও সত্য—এই দেশে কোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকাকালে ভুল স্বীকার করার সাহস দেখায়নি; সবাই নিজেকে নির্ভুল মনে করে।

১৯৭৫ সালের আগস্টের পর বহু আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ গোপনে, কেউ ভারতে পালিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর গঠিত আওয়ামী লীগ–ন্যাপ–সিপিবির বাকশালের বহু নেতা–কর্মীও ভারতে গিয়েছিলেন—কাদের সিদ্দিকী, শামীম ওসমান, শেখ সেলিম, মুস্তাফা মোহসিন মন্টু, নুরুল ইসলাম নাহিদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মনয়েম সরকার, এসএম ইউসুফ, ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকেই। আজও অনেকেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, যা তাদের কাছে নিরাপদ গন্তব্য। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের—দিল্লিতে সরকার বদলালেও এই সম্পর্ক খুব একটা বদলায় না।

আওয়ামী লীগ কি সবসময়ই ভারতনির্ভর দল থাকবে? এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। দেশে যদি প্রো–চীন, প্রো–রাশিয়া, কিংবা প্রো–পাকিস্তান দল থাকতে পারে, তবে প্রো–ভারত দলও থাকতে পারে। সত্য হলো—ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী। দলটি শিগগিরই উন্মুক্ত রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কি না তা অনেকটাই নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক চাপ—বিশেষত ভারত ও তার মিত্রদের অবস্থানের ওপর। এই প্রেক্ষাপটে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন’-এর দাবি আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক বৈধতার একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে।

এই সত্যটি নজরুলের গানে প্রতিধ্বনিত—“আজ রাজা, কাল ভিখারি—কেহ সমান রহে না।” ইতিহাস মহিমাময় উত্থান এবং নির্মম পতনের গল্পে ভরা—তবুও কেউ তা থেকে শিক্ষা নেয় না।

এদিকে ঢাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। তিনি দেশে নেই; আছেন নয়াদিল্লিতে, যেখানে ভারত সরকার তাঁকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। তিনি এই রায়ের মুখোমুখি হতে ঢাকায় ফিরবেন না। অডিও–ভিডিও বার্তায় তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন—তিনি বিজয়ীর বেশে ফিরবেন। তিনি এখনো নিজেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন—একটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ