ভূমিকম্প: ঢাকার বড় ঝুঁকি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে

 


ভূমিকম্প: ঢাকার বড় ঝুঁকি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে

সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো আবারও দেখিয়ে দিয়েছে যে রাজধানী ঢাকা বড় ধরনের ভূমিকম্পের মুখে কতটা ভulnerable। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূকম্পনকেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থান, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং উচ্চ জনঘনত্ব—সবই একটি বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

শুক্র ও শনিবার মাত্র ৩১ ঘণ্টার ব্যবধানে চারটি ভূমিকম্প ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় আঘাত হানে। সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল শুক্রবার সকালে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প, যার উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদী—ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। ভূকম্পকেন্দ্র ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে, ফলে কম গভীরতার কারণে কম্পন ছিল অত্যন্ত তীব্র। সাম্প্রতিক স্মৃতিতে এটি অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প। এতে শিশু-সহ ১০ জন মারা গেছেন এবং ৬০০-র বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও তিনটি ভূমিকম্প হয়—সকাল ১০:৩৬ মিনিটে ৩.৩ মাত্রা, সন্ধ্যায় ৪.৩ মাত্রা (দুটি-ই নরসিংদীতে), এবং একই সন্ধ্যায় বাড্ডায় ৩.৭ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার কম্পন বড় ভূমিকম্পের পূর্ব-সংকেত হতে পারে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) গত পাঁচ বছরের তথ্য এই উদ্বেগকে আরও জোরালো করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ থেকে ২২ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশে মোট ৩৯টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি—অর্থাৎ প্রায় ২৮ শতাংশ—ঢাকা থেকে ৮৬ কিলোমিটারের মধ্যে উৎপন্ন। আরও ২৮টি ভূমিকম্প ঢাকার ১০০–২৬৭ কিলোমিটারের মধ্যে ঘটেছে। মোট ১৮টি জেলায় ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে।

বিএমডির ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক কর্মকর্তা মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, নরসিংদীতে আগেও ছোট ছোট কম্পন হয়েছে, কিন্তু মাত্রা কম হওয়ায় সেগুলো গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশ তিনটি সক্রিয় টেকটনিক প্লেটের কাছে অবস্থিত; ছোট কম্পন স্বাভাবিক হলেও বড় ভূমিকম্প সাধারণত প্লেটের সংযোগস্থলে হয়। তিনি বলেন, “নরসিংদীতে একটি সাব-ফল্ট আছে, যা এখন দেখা যাচ্ছে ঢাকার দিকে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক ভূমিকম্প দেখাচ্ছে, ঢাকা বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে।”

রাতেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প

বিএমডির তথ্য অনুযায়ী, ৩৯টির মধ্যে ২৩টি ভূমিকম্প রাত ৬টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে হয়েছে। মানুষ রাতের সময় ঘুমিয়ে থাকে বা ঘরের মধ্যে থাকে বলে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি তখন বেশি।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হুমায়ুন আকতার বলেন, সাবডাকশন জোনে জমে থাকা শক্তির এক শতাংশেরও কম এখন পর্যন্ত মুক্ত হয়েছে। “বারবার কম্পন দেখাচ্ছে—বড় ভূমিকম্পের পথ তৈরি হচ্ছে।” শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর আফটারশক হওয়াকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন, কারণ দীর্ঘদিন ধরে চাপ ধরে থাকা ফল্টলাইন এখন সরে শক্তি মুক্ত করা শুরু করেছে।

ঢাকা এত বড় ঝুঁকিতে কেন?

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রকিব আহসান চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন—

1. এপিসেন্টারের খুব কাছে অবস্থান, এবং নতুনভাবে শনাক্ত হওয়া সক্রিয় ফল্টলাইন ঢাকার দিকেই বিস্তৃত।

2. মাটির গঠন, বিশেষ করে ঢাকার নতুন এলাকাগুলো নরম ও ভরাট মাটিতে গড়ে ওঠায় কম্পন তীব্রভাবে বাড়ে।,

3. ভবন নির্মাণে কোড না মানা, ভূমিকম্প-সহনশীল ডিজাইনের অভাব।

4. উচ্চ জনঘনত্ব, যা ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।

প্রস্তুতি: কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ

২০১৬ সালে চীন–বাংলাদেশের মধ্যে ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় অপারেশন সেন্টার নির্মাণের চুক্তি হলেও প্রায় এক দশকেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। তেজগাঁওয়ে জমি বরাদ্দ থাকলেও প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জায়গা পাওয়া যায়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানর রহমান বলেন, বিভিন্ন সংস্থার জন্য ভূমিকম্প ও দুর্যোগ মোকাবিলার সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস বড় দুর্যোগে মাঠে নামে। ৪৮ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবককে সচেতনতা কার্যক্রমে যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

তবে দুর্যোগ ফোরামের সদস্য সচিব গওহর নঈম ওয়ারা মনে করেন, প্রস্তুতি এখনও অপর্যাপ্ত। তিনি বলেন, নরসিংদী থেকে তথ্য আসতে এক দিনেরও বেশি লেগেছে—যেখানে এমন ঘটনা হলে তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসার কথা।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকারকে কার্যকরভাবে যুক্ত না করলে সাফল্য আসবে না। পাশাপাশি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে দুর্যোগ সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেন। “শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে ডরমেটরি থেকে লাফ দিয়েছে—এটা কেন হবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মহড়া করে না। এসব স্কুল থেকেই শেখানো উচিত।”


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ