৭ গোলের ম্যাচে বাংলাদেশের হারের ৫ কারণ: হংকংয়ের বিপক্ষে কেন হারল লাল-সবুজ দল?
হংকংয়ের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের গোলে ৪-৩ ব্যবধানে হারের পর হতাশা বিরাজ করছে বাংলাদেশ শিবিরে। এত চমৎকার নৈপুণ্য দেখিয়েও কেন হারতে হলো – এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল খেলোয়াড়, কোচ ও ২২ হাজার দর্শকের মনে। কেন এই হার? মাঠের পারফরম্যান্স ও কৌশলগত ভুল বিশ্লেষণ করে হারের পাঁচটি প্রধান কারণ তুলে ধরা হলো:
১. রক্ষণের দুর্বলতা ও ভুল একাদশ নির্বাচন
বাংলাদেশের হারের প্রধান কারণ ছিল রক্ষণের শোচনীয় অবস্থা। সেন্ট্রাল ডিফেন্সের দুই মূল খেলোয়াড়ের ফিটনেস নিয়েই ছিল প্রশ্ন:
তারিক কাজী: তিনি ছিলেন অর্ধেক ফিট।
তপু বর্মণ (সিনিয়র): তিনি ছিলেন পুরোপুরি আনফিট।
কোচ হাভিয়ের কাবরেরা রক্ষণের মূল দুটি জায়গায় বেহাল অবস্থা জেনেও তারিকের পাশে অনভিজ্ঞ শাকিল আহাদ তপুকে একাদশে রাখেন। শাকিল আহাদ এখনো বড় ম্যাচের চাপ সামলাতে পারেননি।
কোচ রক্ষণে সুরক্ষিত করার জন্য ইয়াছিন আরাফাতকে নিতে পারতেন। কিন্তু কোচ প্রায়ই বলেন যে ইয়াছিন 'বিল্ডআপ' খেলতে পারেন না। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হংকংয়ের বিপক্ষে যখন দুজন গুরুত্বপূর্ণ ডিফেন্ডার চোটগ্রস্ত, তখন বিল্ডআপের চেয়ে রক্ষণ মজবুত করা বেশি জরুরি ছিল। ম্যাচের একপর্যায়ে অর্ধেক ফিট তারিককে উঠিয়ে নিতে হয়। শেষদিকে নিরুপায় হয়ে আনফিট তপু বর্মণকে নামাতে হয়—যা স্পষ্ট করে দেয় হংকং ম্যাচে বাংলাদেশের রক্ষণ কতটা নড়বড়ে ছিল।
২. উইং পজিশনে রাকিবের ভুল ব্যবহার
ফুটবলের অধিকাংশ গোল আসে উইং থেকে ক্রসের মাধ্যমে। এই কাজটি ডান উইং থেকে দারুণভাবে করতে পারেন রাকিব হোসেন। কিন্তু হংকং ম্যাচে তাঁকে স্ট্রাইকার পজিশন থেকে উইংয়ে সরিয়ে আনা হয়। এতে প্রতিপক্ষ সহজেই তাঁর ক্রস করার রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশের এই মুহূর্তে কোনো 'নাম্বার নাইন' না থাকলেও, এই ম্যাচে মিডফিল্ডাররা গোল করেছেন। কিন্তু উইং প্লে কার্যকর হয়নি। রাকিবকে প্রথাগত উইঙ্গার হিসেবে খেলালেই হয়তো স্ট্রাইকারের পজিশনে কার্যকরী ক্রস যেত এবং তিনি আরও বেশি কার্যকর হতে পারতেন; কিন্তু কোচ এই কৌশল নেননি।
৩. তৃতীয় গোলের পর মনোযোগ হারানো এবং কোচের অতিরিক্ত উদযাপন
যোগ করা সময়ের নবম মিনিটে বাংলাদেশ নাটকীয়ভাবে ৩-৩ সমতা ফেরায়। এই গোলের পর পুরো দল কার্যত মনোযোগ হারিয়ে ফেলে।
কোচ কাবরেরা যেভাবে ওই গোল উদযাপন করেছেন, তা ছিল অভাবনীয়। গোল হয়েছে ভালো কথা, কিন্তু খেলা তো তখনও বাকি। কোচ যেন সেটাই ভুলে যান। শেষ এক-দুই মিনিটে কী করতে হবে, তার কোনো নির্দেশনা ছিল না। সেই কারণেই শেষ বাঁশির কয়েক সেকেন্ড আগে গোল হজম করে বাংলাদেশ ম্যাচটি হারে।
৪. শমিত সোমকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা
এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে টিকে থাকার লড়াইয়ে এই ম্যাচটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোচ সেরা দলটিকে নামালেন না! তাঁর একাদশ নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
শমিত সোম কানাডা থেকে খেলার জন্যই এসেছেন। বদলি নেমে তিনি যেভাবে খেলেছেন এবং গোল করেছেন, তাতে তাঁকে একাদশে রাখা যেত।
কোচ আগে থেকেই জানিয়েছিলেন যে তিনি শমিতকে শুরুতে রাখবেন না—যা তাঁর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে এখন মনে হচ্ছে।
শমিত যেকোনো বিচারেই বাংলাদেশের অন্য ফুটবলারদের চেয়ে এগিয়ে। তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখার কোনো অর্থ হয় না।
অন্যদিকে, তরুণ লেফট ব্যাক জায়ান আহমেদ অনূর্ধ্ব-২৩ দলে ভালো খেললেও তাঁকে একাদশে না নেওয়ার বিষয়টি প্রশ্ন সৃষ্টি করে। জায়ান বদলি নেমে দেখিয়ে দিয়েছেন সাদের জায়গায় তিনিই বেশি কার্যকর হতে পারতেন। সাদকে যেন জোর করে খেলানো হচ্ছিল; তাঁর পায়ের ফাঁক গলে বল বেরিয়েছে, যা রক্ষণে মারাত্মক ভুল। জাতীয় দলে এমন ভুলের খেসারত দিতেই হয়, যা হংকং দেখিয়ে দিল।
৫. মাঝমাঠে দুই সোহেল রানার কার্যকারিতা না থাকা
কোচ মাঝমাঠে দুই সোহেল রানাকে খেলিয়েছিলেন। কিন্তু এই দুজনের কারো কার্যকারিতা চোখে পড়েনি।
সোহেল রানা (সিনিয়র) অনেক বছর ধরে খেলছেন, কিন্তু গোলে দু-একটি শট নেওয়া ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান প্রায় নেই বললেই চলে।
সোহেল রানা (জুনিয়র) বেশি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নেই এবং হংকং ম্যাচের চাপও তিনি নিতে পারেননি।
মাঝমাঠের এই দুর্বলতা থেকেই বোঝা যায় যে হংকং ম্যাচের জন্য কোচের একাদশ নির্বাচন সঠিক ছিল না। সামগ্রিকভাবে, রক্ষণের দুর্বলতা, উইংয়ের ভুল ব্যবহার এবং ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে মনোযোগ হারানোর সম্মিলিত ফল হিসেবেই বাংলাদেশকে এই হার বরণ করতে হলো।


0 মন্তব্যসমূহ