নতুন বাংলাদেশ গড়তে ঐক্য, যুব সুরক্ষা ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার দেশের যুবসমাজকে সুরক্ষিত রাখা এবং শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন নিশ্চিত করতে সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি পরাজিত ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসী শক্তির অপচেষ্টা প্রতিহত করার ওপর গুরুত্ব দেন।
২০২৫ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, “আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করুন। যুবসমাজকে রক্ষা করতে পারলে আমরা সবাই এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও নিরাপদ থাকবে।”
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অগ্রণী যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর সাম্প্রতিক হামলার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই ঘটনা তরুণ নেতৃত্বকে সুরক্ষিত রাখার জরুরি প্রয়োজনকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
ভাষণের শুরুতে তিনি দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত সব বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিজয় দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করে। এ উপলক্ষে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ১৯৭১ সালের বিজয় নতুন ভোরের সূচনা করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের কারণে সেই আলো ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
তবে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে সংঘটিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ আবারও “বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা” প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে পরাজিত হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া শক্তিগুলো এখন নির্ভীক ও নিরস্ত্র তরুণদের নিজেদের ক্ষমতায় ফেরার প্রধান বাধা হিসেবে দেখছে।
“তারা জানে, নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে তাদের সহযোগীদের পক্ষে জনসমর্থন পাওয়া কঠিন হবে। সে কারণেই তারা তড়িঘড়ি করতে চাইছে। বিভিন্ন উপায়ে নির্বাচনের আগেই ফিরে আসার চেষ্টা চলছে। তরুণ এক নেতার প্রাণনাশের এই গোপন প্রচেষ্টা তারই একটি উদাহরণ, আর তাদের আরও ভয়ংকর পরিকল্পনাও প্রস্তুত রয়েছে,” বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
দেশবাসীর প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সবাইকে উচ্চকণ্ঠে বলতে হবে—আমরা যুবসমাজকে রক্ষা করব। শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে আমরা সম্মিলিতভাবে দেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করব।”
তিনি জনগণকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ভোটের আগের সময়গুলোকে উৎসবমুখর রাখতে হবে এবং সহিংসতামুক্ত রাখতে হবে।
“আমাদের কিশোর ও তরুণদের মনে কোনো ভয় নেই,” বলেন অধ্যাপক ইউনূস। “তারা আগামী কয়েক মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে উৎসবে পরিণত করবে এবং দেশকে সহিংসতা ও সংঘাত থেকে রক্ষা করবে।”
শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আজ আমি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি।”
তিনি বলেন, “এটি কোনো ব্যক্তির ওপর হামলা নয়; এটি বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ওপর হামলা।”
প্রধান উপদেষ্টা জানান, হাদি এখনো সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন এবং তাঁর চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
“উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে,” বলেন তিনি, দেশবাসীকে তাঁর সুস্থতার জন্য দোয়া করার আহ্বান জানিয়ে।
তিনি বলেন, সরকার ঘটনাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং হামলায় জড়িতদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে।
“এই ষড়যন্ত্রে জড়িত কাউকেই—যেখানেই থাকুক—ছাড় দেওয়া হবে না,” দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি আরও বলেন, পরাজিত ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসী শক্তির এই অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে।
“ভয়ভীতি, সন্ত্রাস কিংবা রক্তপাতের মাধ্যমে কেউই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা থামাতে পারবে না,” তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন।
গুজব ও অপপ্রচারে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্য ও সংযমের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। তাদের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।”
তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি এই দেশের পবিত্র মাটিতে আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না।”
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা গোটা জাতির জন্য উদ্বেগের বিষয়।
তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার তাঁর চিকিৎসাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং পরিবারের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে সব ধরনের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করছে—প্রয়োজনে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হবে।

0 মন্তব্যসমূহ