ঢাকা–দিল্লি সম্পর্কে উত্তেজনা



ঢাকা–দিল্লি সম্পর্কে উত্তেজনা, আজ চালু থাকবে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র

বাংলাদেশে ‘ক্রমাবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি’ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানাতে গতকাল বুধবার দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর প্রায় দুই ঘণ্টা আগে ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র (আইভেক) সাময়িকভাবে কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয় ভারতের হাইকমিশন।

গতকাল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের মোর্চা ‘জুলাই ঐক্য’ ঢাকায় মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত আইভেকের কার্যক্রম বেলা দুইটা থেকে বন্ধ রাখা হয়। তবে ভারতের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার ভিসা কেন্দ্রের কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মে চালু থাকবে

বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চলমান টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনাকে নতুন করে উত্তেজনার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে উভয় দেশ একে অপরের হাইকমিশনারকে তলব করায় সম্পর্কের অস্বস্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

তলবের প্রক্রিয়ায় পার্থক্য

বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত রোববার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেভাবে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করেছিল, দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহর ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি ছিল ভিন্ন। প্রণয় ভার্মাকে আগের দিন তলবের বিষয়টি জানানো হলেও, গতকাল সকালে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ফোন করে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে রিয়াজ হামিদুল্লাহকে দিল্লির জওহরলাল নেহরু ভবনে অবস্থিত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়।

দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাংলাদেশ–মিয়ানমার বিভাগ) বি শ্যাম হাইকমিশনারকে তলব করেন। স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার পর শুরু হওয়া এই বৈঠক প্রায় ১৫ মিনিট স্থায়ী হয়।

তলবের পর এক বিজ্ঞপ্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশে ক্রমাবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নয়াদিল্লির গভীর উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ঘিরে ‘কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী’র নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটানোর পরিকল্পনার ঘোষণার বিষয়টি হাইকমিশনারের নজরে আনা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার আলোকে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় সব মিশন ও পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে—এমন প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জানিয়েছে ভারত।

বাংলাদেশের অবস্থান

ঢাকার একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, আলোচনায় মূলত বাংলাদেশে ভারতীয় মিশনের নিরাপত্তা নিয়ে দিল্লির উদ্বেগই প্রাধান্য পায়। এ সময় বাংলাদেশের হাইকমিশনার স্পষ্টভাবে জানান, একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভারতীয় মিশন ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে

নতুন করে টানাপোড়েন

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ১৬ মাস ধরেই বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। বিশেষ করে গত ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সম্পর্কের উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচনবিরোধী বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করা হয়।

এর এক দিন পর, ১২ ডিসেম্বর, ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সমর্থক ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। আলোচনায় রয়েছে, হত্যাচেষ্টায় জড়িতরা ভারতে পালিয়ে গেছে।

এই প্রেক্ষাপটে ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে জানানো হয়, ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চায় ঢাকা। একই সঙ্গে হাদিকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজনরা ভারতে প্রবেশ করলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়।

এর পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। পাশাপাশি বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ভারতের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়।

‘নসিহতের প্রয়োজন নেই’

বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলবসহ নির্বাচন ইস্যুতে ভারতের বক্তব্য প্রসঙ্গে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন

তিনি বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই ভালো ও কার্যকর সম্পর্ক চাইছি। কিন্তু সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দুই পক্ষেরই চেষ্টা দরকার। সম্ভবত সেই জায়গায় আমরা প্রত্যাশিত অগ্রগতি করতে পারিনি।’

নির্বাচন নিয়ে ভারতের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের নসিহত করার কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, সে বিষয়ে আমরা প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না।’

তৌহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অত্যন্ত উচ্চমানের নির্বাচন আয়োজন করতে চায়, যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে—যে পরিবেশ গত ১৫ বছর ছিল না।

তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৫ বছর যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সেই সময় নির্বাচনগুলো প্রহসনে পরিণত হলেও ভারত একটি শব্দও বলেনি। এখন যখন আমরা একটি ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, তখন উপদেশ দেওয়া সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।’

‘আমরা তো থামাতে পারি না’

ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার বক্তব্য বন্ধে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারত যদি তাঁকে থামাতে না চায়, আমরা তো থামাতে পারি না। এটাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে আমরা চাইব, ভারত তাঁকে থামাক।’

তিনি বলেন, উসকানিমূলক বক্তব্য যেন বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট না করে। এসব বক্তব্য বন্ধ হলে বাংলাদেশ তা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখবে।

বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তায় বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না থাকা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে তৌহিদ হোসেন বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত–পাকিস্তানের যুদ্ধ’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তাদের সামরিক ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ছাড়া এই বিজয় সম্ভব হতো না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ