ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের দায় ‘নিরাপত্তা বাহিনী’র ওপর চাপালেন শেখ হাসিনা

 



ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের দায় ‘নিরাপত্তা বাহিনী’র ওপর চাপালেন শেখ হাসিনা: দায় কার—রাজনীতি না রাষ্ট্রযন্ত্রের?


শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের দায় চাপালেন নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর | জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিশ্লেষণ

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডে মূল সমন্বয়কের ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি দায় দিয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর। জানুন পুরো ঘটনার পটভূমি ও প্রতিক্রিয়া।

শেখ হাসিনা, জুলাই গণঅভ্যুত্থান, নিরাপত্তা বাহিনী, ছাত্র আন্দোলন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জাতিসংঘ প্রতিবেদন, বাংলাদেশ রাজনীতি


ভূমিকা: দায় অস্বীকারে নতুন বিতর্ক

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো দমন-পীড়নের মূল সমন্বয়ক ছিলেন শেখ হাসিনা। অথচ তিনি দাবি করেছেন, “নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য পরিস্থিতির চাপে ভুল করেছিলেন।”১৫ মাস আত্মগোপনে থাকার পর এক লিখিত সাক্ষাৎকারে এই বক্তব্য প্রকাশ করে তিনি আবারও রাজনৈতিক ও নৈতিক দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলে বিশ্লেষকদের মত।


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি: এক ছাত্র আন্দোলনের বিস্ফোরণ

কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সর্বজনীন ক্ষোভে রূপান্তর

২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্রলীগকে আন্দোলন দমনে মাঠে নামালে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার “রাজাকারের নাতিপুতি” মন্তব্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলন দমন শুরু হয়।

সহিংসতা ও প্রাণহানির মর্মন্তুদ পরিসংখ্যান

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) জানিয়েছে, জুলাই-আগস্টে সহিংসতায় নিহত হন এক হাজার চারশ’রও বেশি মানুষ।বেশিরভাগ মৃত্যু ঘটে নিরাপত্তা বাহিনীর শটগান ও সামরিক অস্ত্রের গুলিতে। ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ গ্রেপ্তার এবং হাজারো ছাত্র-জনতা পঙ্গু বা দৃষ্টিশক্তি হারান।


জাতিসংঘ ও বিবিসির অনুসন্ধান: নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা

জাতিসংঘ প্রতিবেদন যা বলছে

ওএইচসিএইচআর-এর রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, এই দমন-পীড়নের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছিলেন শেখ হাসিনা।
তদন্তে উঠে আসে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের প্রতিটি স্তরে নির্দেশ গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।

ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং: ‘প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি’

বিবিসি প্রকাশিত একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে শোনা যায়, শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেন—

“যেখানেই আন্দোলনকারী দেখবে, গুলি করবে।” এই রেকর্ডিং আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র নিন্দার জন্ম দেয় এবং হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা গতি পায়।


দায় অস্বীকারে শেখ হাসিনা: ‘নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ভুল করেছেন’

রাজনৈতিক দায় এড়ানোর কৌশল

দ্য হিন্দু পত্রিকায় ইমেইল সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন—

“সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যের আচরণে নিঃসন্দেহে ভুল হয়েছিল।” তবে তিনি দাবি করেন, “জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল সৎ উদ্দেশ্যপ্রসূত।”
বিশ্লেষকদের মতে, এটি দায় এড়ানোর রাজনৈতিক প্রচেষ্টা, কারণ নির্দেশদাতা হিসেবে প্রমাণ ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সংস্থার নথিতে রয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাকে তিনি বলেছেন “প্রহসনমূলক আদালত”, যা তার রাজনৈতিক শত্রুরা নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি আরও বলেন, “রায় আগেই নির্ধারিত, মৃত্যুদণ্ডের দাবি আসলে রাজনৈতিক প্রতিশোধ।”


নির্বাচন ও ক্ষমতার রাজনীতি: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

বিনা ভোটের তিন নির্বাচন

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। এই নির্বাচনে ভারতের পরোক্ষ সহায়তার অভিযোগও উঠেছে বারবার।

২০২৬ সালের নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা

তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন “বৈধ হবে না” যদি আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারে। আগে যিনি বর্জনের আহ্বান দিয়েছিলেন, এখন তিনি বলছেন—

“আমি বর্জনের আহ্বান দিইনি, শুধু বলেছিলাম সমর্থকরা ভোট দেবে না যদি অংশ নিতে না পারি।”

পলায়ন, নির্বাসন ও নতুন অভিযোগ

৫ আগস্ট দেশত্যাগ ও পদত্যাগের রহস্য

হাসিনা দাবি করেছেন, “আমি পদত্যাগ করিনি, রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো চিঠি দিইনি।”
তিনি ভারতের আশ্রয়ে পালিয়ে যান, সঙ্গে বহু মন্ত্রী-এমপি ও কর্মকর্তাও দেশত্যাগ করেন।

ফেরার অনীহা ও ‘উগ্রপন্থি নিয়োগ’ অভিযোগ

তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকারে “উগ্রপন্থিদের” নিয়োগ তাকে দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করছে।
রাজনৈতিক মহল বলছে, এটি তার অবস্থান বৈধতা দেওয়ার এক প্রকার প্রচার কৌশল।

বিশ্লেষণ: দায় অস্বীকারের রাজনীতি নাকি আত্মপক্ষ সমর্থন?

রাজনীতিতে দায় এড়ানো নতুন নয়, কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও জটিল করেছে। একদিকে জাতিসংঘের প্রমাণভিত্তিক প্রতিবেদন, অন্যদিকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর আত্মপক্ষ সমর্থন—এই দ্বন্দ্বই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।


উপসংহার: ইতিহাস কি ক্ষমা করবে?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় লিখেছে।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—

দায় কার?”
নিরাপত্তা বাহিনীর, না কি সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের, যারা নির্দেশ দিয়েছিল? ন্যায়বিচার ও সত্য উদ্ঘাটনই পারে এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের প্রকৃত সমাপ্তি টানতে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ