জাপানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী: সানায়ে তাকাইচি
জাপানের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। সানায়ে তাকাইচি দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। মঙ্গলবার (অনুষ্ঠিত) ভোটাভুটিতে জাপানের শাসক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) এই প্রার্থী সংসদের নিম্নকক্ষ (২৩৭ ভোট) ও উচ্চকক্ষ (১২৫ ভোট) উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন।
রক্ষণশীল 'আয়রন লেডি'র উত্থান
'জাপানের আয়রন লেডি' হিসেবে পরিচিত তাকাইচি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঘনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি আবের মতোই দৃঢ় রক্ষণশীল ভাবধারার রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। জাপানের রাজনীতিতে যখন নারীর অংশগ্রহণ এখনো সীমিত, তখন তাঁর এই জয়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে জাপানের তরুণীরা সংশয় প্রকাশ করেছেন যে একজন রক্ষণশীল হিসেবে তাকাইচি নারীর অধিকারকে আদৌ এগিয়ে নেবেন কিনা।
রাজনৈতিক টালমাটাল ও 'হর্স ট্রেডিং'
তাকাইচি এমন এক সময় ক্ষমতায় এলেন যখন এলডিপি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত এবং জনসমর্থন কমছে। চলতি মাসের শুরুতে তিনি এলডিপির নেতা নির্বাচিত হলেও, জোট সরকার ভেঙে যাওয়ায় তাঁর প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রচেষ্টা ভেস্তে গিয়েছিল।
তাঁর এই জয় সম্ভব হয়েছে তীব্র 'হর্স ট্রেডিং'-এর (রাজনৈতিক দেনদরবার) মাধ্যমে। তাকাইচির কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত ও মন্তব্যের কারণে ক্ষমতাসীন জোটের ছোট অংশীদার কোমেই পার্টি ২৬ বছরের বন্ধন ছিন্ন করে জোট ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এর ফলে এলডিপি নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে।
'হর্স ট্রেডিং': সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে এলডিপি তখন ৩৫ আসন থাকা জাপান ইনোভেশন পার্টি (জেআইপি)-এর সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে।
ছাড়: প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তাকাইচি জেআইপি-র দুটি প্রধান দাবি মেনে নেন—সরকারের কেন্দ্রীভূতকরণ কমিয়ে কিছু সরকারি কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ওসাকায় সরিয়ে আনা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিমার প্রিমিয়াম হ্রাস করা।
এই দেনদরবারের ফলেই তাকাইচি পুনরায় প্রধানমন্ত্রিত্বের পথে এগিয়ে যান এবং ভোটাভুটিতে নির্বাচিত হন। তবে এটি একটি সংখ্যালঘু সরকার হতে পারে, যার স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে।
জয়ের নেপথ্যে 'কিং মেকার'
দলীয় সভাপতি নির্বাচনে তাকাইচির জয়ের পেছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল উপদলীয় নেতা তারো আসোর। আসোর উপদলের সমর্থন পাওয়ায় তিনি অগ্রবর্তী প্রার্থীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। এর ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হলেও আসো পেছন থেকে 'কিং মেকার' হিসেবে নির্দেশনা দেওয়া অব্যাহত রাখতে পারেন।
পররাষ্ট্রনীতি ও চীন-মার্কিন সম্পর্ক
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকাইচির সামনে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
যুক্তরাষ্ট্র: তিনি যুক্তরাষ্ট্র-জাপান সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং শুল্ক নিয়ে সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। তিনি শীঘ্রই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সহযোগিতা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেছেন। ট্রাম্পের জাপান সফরের পরিকল্পনাও চলছে।
চীন: তাকাইচির ইয়াসুকুনি মন্দিরে নিয়মিত শ্রদ্ধা জানানোর অভ্যাস চীনের উদ্বেগের কারণ। এই মন্দিরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীরাও সমাহিত। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাপানকে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক দলিলে সম্মত নীতিমালা মেনে চলতে সতর্ক করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখন থেকে তাকাইচিকে চীন সংক্রান্ত যেকোনো পদক্ষেপে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ও বিতর্কের বিষয়
তাকাইচির সামনে দেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: তিনি সব দলকে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেও, সমাধানের পথ এখনো পরিষ্কার নয়।
প্রতিরক্ষা নীতি: তাকাইচি প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করে সামরিক শক্তি আরও সংহত করার পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শত্রু দেশে আগাম হামলা চালানোর নীতির পক্ষে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেন কিনা, সেদিকে নজর থাকবে।
সামাজিক নীতি ও নারীর অধিকার: নিজে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নারীর অধিকার ও লিঙ্গ সমতার বিষয়ে তাঁর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে:
তিনি স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব পারিবারিক পদবি ব্যবহারের বিরোধিতা করেন।
তিনি সিংহাসনে নারীর উত্তরাধিকারের ঘোরতর বিরোধী।
সমকামী ও লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের অধিকারের বিষয়েও তাঁর অবস্থান সমালোচিত।

0 মন্তব্যসমূহ