সোনার দাম: আর কত দূর পর্যন্ত যাবে?

 




সোনার দাম: আর কত দূর পর্যন্ত যাবে?

সোনার দামে নতুন রেকর্ড: ইতিহাসের 'গোল্ড রাশ'

সোনার দাম এখন অনেকেরই আলোচনার কেন্দ্রে। ক্রমেই দাম বাড়ছে, নিত্যনতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। সোনা প্রতি আউন্স ৪,২০০ ডলারের সীমা ভেঙেছে, যা ইতিহাসে 'সবচেয়ে বড় গোল্ড রাশ' হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। চলতি ২০২৫ সাল সোনার জন্য ছিল অবিশ্বাস্য। এই বছর সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশেরও বেশি। এটি ১৯৭৯ সালের পর সেরা বছর হতে পারত। শুধু সোনাই নয়, প্লাটিনামের দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ এবং রুপার দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ, অর্থাৎ সব মূল্যবান ধাতুই ঊর্ধ্বমুখী।

অনিশ্চয়তার ব্যারোমিটার

সোনাকে প্রায়শই 'বিশ্ব উদ্বেগের ব্যারোমিটার' বলা হয়। যখনই বিশ্বে অর্থনৈতিক বা ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন বাড়ে, মানুষ নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনার দিকে ঝোঁকে। এবারকার এই উত্থান অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুল্ক-যুদ্ধ উত্তপ্ত হওয়া এবং ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের বছরের শেষে আরও একবার সুদের হার কমানোর ইঙ্গিতের পরই সোনার দাম আবার বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মিশ্র মনোভাব

জেপি মরগান চেজের প্রধান নির্বাহী জেমি ডাইমন মনে করেন, পোর্টফোলিওর কিছু অংশ সোনায় রাখা আংশিকভাবে যুক্তিযুক্ত। তবে সিটাডেল ইনভেস্টমেন্ট ফার্মের প্রধান কেন গ্রিফিন সতর্ক করে বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরা যেভাবে ডলারের মতো সোনাকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভাবছে, তা উদ্বেগজনক।

আসলে এই 'গোল্ড রাশ' বিনিয়োগকারীদের মানসিকতা পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। যখন কোনো দেশের মুদ্রা বা বন্ডের ওপর মানুষের বিশ্বাস কমে যায়, তখন তারা এমন সম্পদের দিকে যায় যার কোনো তৃতীয় পক্ষ বা সরকার নেই। এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনই সোনার দামকে এতটা ওপরে তুলেছে।

সংকটে ঝলমলে সোনা

ইতিহাস বলে, সোনা সব সময়ই সংকটের সময় ভালো করে। ২০০৮ সালের ধস বা ২০২০ সালের মহামারির সময়ও তাই হয়েছিল। বর্তমানে বাণিজ্যযুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা—এই সব 'খারাপ খবর'ই সোনার জন্য 'ভালো খবর' বয়ে আনছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০২২ সালে, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বৈদেশিক সম্পদ জব্দ করে। তখন অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুঝতে পারে যে, ডলার বা ইউরোতে রাখা রিজার্ভ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু নিজেদের দেশে রাখা সোনা কেউ জব্দ করতে পারবে না। সে সময় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৫০০ টন থেকে প্রায় ১ হাজার টনে পৌঁছেছে প্রতি বছর।

সবচেয়ে বড় ক্রেতা: চীন ও অন্যরা

বর্তমানে সোনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা হল চীন। এরপরেই আছে ভারত এবং পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ, যেমন পোল্যান্ড, সার্বিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র। এই দেশগুলো দ্রুত নিজেদের রিজার্ভকে বড় অর্থনীতির সঙ্গে মানানসই করতে সোনার ভান্ডার তৈরি করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও ফেডের স্বাধীনতা

সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও সোনার দিকে ঝুঁকছে, বিশেষ করে যখন ট্রাম্প প্রশাসন ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। ফেডের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প হিসেবে সোনার দিকে যাচ্ছে। শ্রমবাজার দুর্বল হওয়ার কারণে ফেড সুদের হার কমাচ্ছে, যার ফলে ব্যাংকে নগদ রাখা বা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের আগ্রহ কমছে, আর সুদবিহীন সোনা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

রুপার চমক ও বিনিয়োগের কৌশল

সোনার পাশাপাশি রুপার দামও দারুণভাবে বেড়েছে, কারণ এটি শিল্প খাতে (বিশেষত সৌর প্যানেল তৈরিতে) ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এ খাতেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

সোনা কেনার অনেক উপায় আছে: কেউ ছোট বার বা কয়েন কিনে কাছে রাখে, কেউ ফিউচারস বা গোল্ড-ব্যাকড স্টেবলকয়েন কেনে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজ উপায় হলো গোল্ড ইটিএফে (এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ড) বিনিয়োগ

ইতিহাসের শিক্ষা: ১৯৭০-এর দশক

সোনার সেরা সময় ছিল ১৯৭০-এর দশকে, যখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন 'গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড' তুলে নেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দুর্বল প্রবৃদ্ধি (স্ট্যাগফ্লেশন) ছিল, সঙ্গে ছিল তেলের সংকট, যুদ্ধ ও ফেডের ওপর রাজনৈতিক চাপ। সেই সময় সোনার দাম ভয়ংকরভাবে বেড়ে ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে প্রতি আউন্স ৮০০ ডলারে পৌঁছে, যা আজকের হিসাবে প্রায় $৩,৬০০। তবে এরপরই ফেড সুদের হার বাড়ালে দাম দ্রুত পড়ে যায়।

সোনার সমালোচকেরা

বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেটের মতো সমালোচকেরা বলেন, সোনা কোনো উৎপাদনশীল সম্পদ নয়, এটি মূলত 'ভয়কে কেন্দ্র করে বিনিয়োগ'। সোনা থেকে কোনো আয় আসে না এবং যখন দাম টানা বাড়তে থাকে, তখন বাজারে অতিরিক্ত উন্মাদনা বা 'ফোমো' (ফিয়ার অব মিসিং আউট) তৈরি হয়, যা বিপজ্জনক সংকেত।

ভবিষ্যদ্বাণী ও স্থিতিশীলতা

বিশ্লেষকদের অনুমানও সোনার গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। অধিকাংশ ব্যাংক এখনো মনে করছে দাম আরও বাড়বে। যেমন ব্যাংক অব আমেরিকা পূর্বাভাস দিয়েছে, আগামী বছরের শেষে দাম পাঁচ হাজার ডলার প্রতি আউন্সে পৌঁছাতে পারে। তবে সোনার মূল্য পুরোপুরি মানুষের মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল।

দাম কমার কারণ

যদি মধ্যপ্রাচ্য বা ইউক্রেনে উত্তেজনা কমে আসে, যদি বিশ্বে শান্তি ও পারস্পরিক বিশ্বাস ফিরে আসে, তাহলে সোনা আবার গুরুত্ব হারাতে পারে এবং দাম কমতে পারে। কিন্তু এখন খুব কম মানুষই শান্তির ওপর বাজি ধরতে প্রস্তুত, কারণ সবাই দেখছেন গত দুই বছরে সোনার দাম দ্বিগুণ হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ