২১ বছরে এইচএসসিতে সর্বনিম্ন পাস: শিক্ষায় ‘গলদ’ না অন্য কিছু
দুই দশকের মধ্যে এবার উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় সবচেয়ে কম পাসের হার রেকর্ড হয়েছে। ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই তা বেড়েছে বা সামান্য ওঠানামা করেছে। কিন্তু এবার যেন ধস নেমেছে। ২১ বছর পর ফলাফলে এসেছে বড় ধাক্কা।
এ বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গড় পাসের হার হয়েছে মাত্র ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ—যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী এবার পাস করতে পারেননি। শুধু তাই নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বিপুলভাবে কমেছে। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন, আগের বছর ৭৮ হাজার ৫২১ জন; কিন্তু এ বছর সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৬৩ হাজার ২১৯ জনে।
আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে মোট ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়, যার মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৬ জন। একই দিনে মাদ্রাসা (আলিম) ও কারিগরি (ভোকেশনাল, বিএম ও ডিপ্লোমা ইন কমার্স) পরীক্ষার ফলও প্রকাশিত হয়েছে।
দুই দশকের ফলাফলের ওঠানামা
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) জানায়, ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ শতাংশের কিছু বেশি। ২০০৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬৪ শতাংশে, ২০০৭ সালে ৬৪ শতাংশের ওপরে, ২০০৮ সালে প্রায় ৭৫ শতাংশে। তবে ২০০৯ সালে তা কমে হয় ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। পরবর্তী বছরগুলোয় পাসের হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে, শুধু ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে নেমেছিল ৭০ শতাংশের নিচে।
২০২০ সালে কোভিড-১৯–এর কারণে সরাসরি পরীক্ষা হয়নি; বিশেষ প্রক্রিয়ায় সবাই উত্তীর্ণ হন। ২০২১ ও ২০২২ সালের বিশেষ পরিস্থিতির পরীক্ষায় পাসের হার ছিল এক বছরে ৮৪ শতাংশের বেশি, অন্য বছরে ৯৫ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালে তা নেমে আসে ৮০ শতাংশের নিচে, আর এবার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৭ শতাংশে—২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইংরেজি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন, যা সামগ্রিক ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলেছে।
গত বছর পরীক্ষার সময় কিছু বিষয় স্থগিত হয়ে যাওয়ায় পরে তা বাতিল করা হয়। যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফল নির্ধারণ করা হয়েছিল এসএসসি ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয়–ম্যাপিং প্রক্রিয়ায়। তখন ধারণা করা হয়েছিল, এতে পাসের হার বাড়বে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং ৯ বোর্ডের গড় ফল আরও কমে যায়।
অন্যান্য সূচকও নিম্নমুখী
এ বছর শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে—গত বছর যেখানে এমন প্রতিষ্ঠান ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি, এবার তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪৫টিতে। অন্যদিকে, কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি—এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২টিতে, যা গত বছর ছিল মাত্র ৬৫টি।
‘অবশ্যই গলদ আছে’
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন,
“আমরা পরীক্ষকদের কোনো ছক দিইনি যে বেশি নম্বর দিতে হবে বা ওভারমার্কিং করতে হবে। নিয়ম মেনে সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, এমনকি সময়ও বাড়ানো হয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন,
“প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করেনি—এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এটা আমাদের জন্য এক ধরনের আয়না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষায় গলদ আছে, অবশ্যই গলদ আছে। সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করে ঠিক করতে হবে। এর দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বোর্ড ও সবার।”
শেখার প্রকৃত সংকট আড়ালে ছিল
শিক্ষা উপদেষ্টা সচিবালয়ের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে,
“এ বছর এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল অনেককে বিস্মিত করেছে। পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কম। প্রশ্ন উঠছে—কেন? উত্তরটি সহজ কিন্তু অস্বস্তিকর: শেখার সংকট বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বহুদিনের। প্রাথমিক স্তর থেকেই শেখার ঘাটতি তৈরি হয় এবং তা বছরের পর বছর জমে থাকে। কিন্তু আমরা এই বাস্তবতা স্বীকার করতে চাইনি। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যেখানে পাসের হারই সাফল্যের মানদণ্ড, জিপিএ-৫–এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মাপকাঠি। ফলাফল ‘ভালো’ দেখাতে গিয়ে আমরা প্রকৃত শেখার সংকট আড়াল করেছি। এখন সময় এসেছে সেই সংস্কৃতি বদলানোর।”


0 মন্তব্যসমূহ