বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিক্রি করে বড় লাভ করছে খনি, কিন্তু সেই কয়লা কিনে ক্ষতির মুখে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র।
আমদানি করা কয়লা কিনতে যেখানে প্রতি টনে গড়ে ৭৫ ডলার খরচ হয়, সেখানে দেশের একমাত্র কয়লাখনি বড়পুকুরিয়ায় উত্তোলিত কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৬ ডলার। এই বাড়তি দামে বিক্রি করে গত তিন অর্থবছর ধরে বড় মুনাফা করেছে সরকারি কয়লা কোম্পানি। মুনাফার অংশ হিসেবে কোম্পানির কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও পাচ্ছেন অতিরিক্ত অর্থ। আর এ দাম পরিশোধ করেই নিয়মিত লোকসান গুনছে পাশে থাকা সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
মুনাফা যায় খনিতে, লোকসান পড়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে
পেট্রোবাংলার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি চীনা ঠিকাদারের সহায়তায় কয়লা উত্তোলন ও বিক্রি করে। আর সেই কয়লাই কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নিজস্ব তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
জ্বালানি বিভাগ জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতি টন কয়লার দাম ১৩০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৭৬ ডলার নির্ধারণ করা হয়। এরপর থেকেই কোম্পানির লাভ দ্রুত বাড়তে থাকে। প্রতিবছর মুনাফার ১০ শতাংশ বোনাস পান কর্মকর্তা–কর্মচারীরা, যার ফলে অনেকে বেতন–ভাতার বাইরে বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন।
এদিকে পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, উচ্চ দামে কয়লা কিনে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি টানা তিন অর্থবছর ক্ষতির মুখে পড়েছে। কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতি খনির কয়লা অনুযায়ী বসানো হওয়ায় আমদানি করা কয়লা ব্যবহার করাও সম্ভব নয়।
দাম কমলে ক্ষতি কিছুটা কমেছে
পিডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, গত জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়া সূচক ধরে কয়লার দাম পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়ে প্রতি টন ৯৯.৫৮ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, ফলে ক্ষতি কিছুটা কমে। তবে ১৭৬ ডলার ধরে পরিশোধ করলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঘাটতি হতো ১,৭৪২ কোটি টাকা।
খনি কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা
খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু তালেব ফরাজী বলেন, বৈঠকের সুপারিশ প্রজ্ঞাপন আকারে হয়নি, তাই ১৭৬ ডলার ধরেই বিল করা হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, বড় গভীরতা থেকে কয়লা তুলতে ঠিকাদারকে টনপ্রতি ৯০ ডলারের বেশি দিতে হয়, যা অনেক দেশের খনির তুলনায় ব্যয়বহুল।
ডলারে আয়, ব্যয় স্থানীয় মুদ্রায়
পেট্রোবাংলা জানায়, চীনা ঠিকাদারকে ডলারে বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয় কিন্তু কোম্পানির বিভিন্ন ব্যয় হয় টাকায়। গত তিন বছরে ডলারের দর ৮৪ টাকা থেকে ১২২ টাকায় ওঠায় শুধু বিনিময় হারের পরিবর্তনের কারণেই কয়লা কোম্পানির আয় প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে।
মান ভালো হলেও দাম দ্বিগুণ কেন?
দেশের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লার গড় দাম ৭৪.৭৬ ডলার হলেও বড়পুকুরিয়ার কয়লার আন্তর্জাতিক মানের দাম প্রায় ৯১.২০ ডলার। তবুও পরিবহন খরচ না থাকায় দাম আরও কম হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রকল্প সম্প্রসারণে জমি অধিগ্রহণে বড় খরচ মেটাতে জ্বালানি বিভাগ কয়লার দাম বাড়িয়ে রাখছে। এমনকি বিভাগীয় কমিটি ২০১ ডলার পর্যন্ত দাম নির্ধারণের মতামত দিয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, “সরকার নিজেই লুণ্ঠনের অংশীদার হয়েছে। বড়পুকুরিয়ার লাভ বাড়িয়ে পিডিবিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমদানির দ্বিগুণ দামে কয়লা কিনতে হলে খনিরই আর দরকার নেই।”
ন্যায্য দাম নির্ধারণে আলোচনার উদ্যোগ
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগকে একসঙ্গে বসিয়ে বড়পুকুরিয়ার কয়লার ন্যায্য দাম পুনঃনির্ধারণ করা হবে।


0 মন্তব্যসমূহ