জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ (চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন) বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। ১৯৯০-এর দশকে তার স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি যে প্রভাব ফেলে গেছেন, তা আজও অম্লান।
কর্মজীবন (Career):
সালমান শাহ'র চলচ্চিত্র জীবন ছিল মাত্র তিন বছরের (১৯৯৩-১৯৯৬)। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি মোট ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
শুরু: তিনি ১৯৮৫ সালে 'পাথর সময়' ধারাবাহিক নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তবে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' সিনেমার মাধ্যমে, যেখানে তার বিপরীতে ছিলেন মৌসুমী। প্রথম ছবিতেই তিনি দর্শকদের মন জয় করে নেন।
সফলতা: তার অভিনীত অনেক ছবিই ছিল ব্যবসায়িক দিক থেকে অত্যন্ত সফল, যেমন - 'স্বপ্নের ঠিকানা', 'সুজন সখী', 'এই ঘর এই সংসার', 'সত্যের মৃত্যু নেই', 'আনন্দ অশ্রু' ইত্যাদি।
উত্তরাধিকার (Legacy): তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রে আধুনিক নায়কের ধারণা প্রবর্তন করেন। তার অভিনয় দক্ষতা, অভিব্যক্তি এবং নিজস্ব স্টাইল তাকে 'ঢালিউডের রাজকুমার' বা 'স্বপ্নের নায়ক' উপাধি এনে দেয়। মৃত্যুর এত বছর পরও তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি।
ফ্যাশন (Fashion):
সালমান শাহ ছিলেন তার সময়ের একজন ফ্যাশন আইকন এবং ট্রেন্ডসেটার। তার স্টাইল ছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
স্টাইল: তিনি পশ্চিমা ফ্যাশনকে দেশীয় চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় করে তোলেন। তার ট্রেডমার্ক লুকের মধ্যে ছিল ব্যান্ডানা (মাথায় বা গলায় বাঁধা রুমাল), হাতে ব্রেসলেট, কানের দুল, গোল ফ্রেমের সানগ্লাস, রঙিন টি-শার্ট এবং স্টাইলিশ জিন্স।
প্রভাব: তার পোশাক এবং স্টাইলকে অনুসরণ করত সেই সময়ের যুব সমাজ। তিনি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তরুণদেরকেও সিনেমা হলে টেনে এনেছিলেন তার আধুনিক চেহারার কারণে।
মৃত্যু ও হত্যা রহস্য (Death and Murder):
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইস্কাটনে নিজ বাসভবনে মাত্র ২৫ বছর বয়সে সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। প্রথমে এই ঘটনাকে 'অপমৃত্যু' বা আত্মহত্যা বলে ধারণা করা হয়।
পরিবারের দাবি: শুরু থেকেই সালমান শাহ'র পরিবার, বিশেষ করে তার মা নীলা চৌধুরী, দাবি করে আসছেন যে তাকে খুন করা হয়েছে।
মামলা: সালমান শাহ'র বাবা প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করলেও পরে এটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে সিআইডি, বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) একাধিকবার তদন্ত করে।
পিবিআই রিপোর্ট: পিবিআই তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে জানায়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক কলহের কারণে সৃষ্ট মানসিক কষ্টের জেরেই তিনি আত্মহত্যা করেন।
সাম্প্রতিক অগ্রগতি: তবে পরিবার এই প্রতিবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। সাম্প্রতিককালে (অক্টোবর ২০২৫) আদালতের নির্দেশে এই অপমৃত্যুর মামলাটিকে হত্যা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে তার স্ত্রী সামিরা হকসহ মোট ১১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘ ২৯ বছর পরেও তার মৃত্যুর রহস্য এখনও পুরোপুরি উদঘাটন হয়নি, যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এক বিরাট আক্ষেপ ও আলোচনার বিষয়।


0 মন্তব্যসমূহ